করোনাভাইরাস মহামারী বিস্তারের প্রেক্ষাপটে লকডাউন ও অন্যান্য কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ছে। বাংলাদেশেও খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম মৎস্য খাত। প্রাণিজ আমিষের ৬০ ভাগ জোগানই আসে মৎস্য খাত থেকে। অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এবং মৎস্যচাষের ওপর ভিত্তি করে খাতটির অর্জন কম নয়। সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ৪২ দশমিক ৭৭ লাখ মেট্রিক টন মৎস্য উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে, অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ১২ লাখ ১৬ হাজার ৫৩৯ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা সম্ভব হয়েছে। আর অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করে ২৪ লাখ ৫ হাজার ৪১৫ মেট্রিক টন উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। একই সময়ে বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে আহরিত হয়েছে ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮৭ মেট্রিক টন মৎস্য।
ঐতিহ্যগতভাবে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ হিসেবে আমাদের খ্যাতি আছে। আধুনিক কালে এসে এখন শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়; আয়-উপার্জনের অবলম্বন হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে মৎস্য চাষ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণে তৃতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে। আর চাষাবাদের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এছাড়া ‘তেলাপিয়া’ জাতের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ ও এশিয়া মহাদেশে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এভাবে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছে মৎস্য চাষ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বর্তমান সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টায় জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে। তবে এখন করোনাভাইরাসের মহামারী বিস্তারের কারণে দেশের বিভিন্ন খাতের মতো এদেশের মৎস্য খাতেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
দেশে যখন করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয় তখনই মাছের মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণের ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক গুজব রটেছিল। তবে সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর সঠিক সময়ে কার্যকর ভূমিকা নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করায় গুজবটি খুব প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু লকডাউনের প্রবল প্রভাবে বিদেশে পণ্য রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ পরিবহন সেবা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে দেশে উৎপাদিত মাছের বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থায় বেশ বড় আঘাত লেগেছে। পরিবহন সংকটে মাছচাষিরা রেণু পোনা সংগ্রহ করতে পারছেন না। ফলে রেণু উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন সারা দেশের উৎপাদনকারীরা। এই পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলোতে শ্রমিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। চাষিরা তাদের উৎপাদন বাজারজাত করতে না পারায় পুকুরে মাছ ফেলে রেখেছেন। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। যে সময় বিক্রি করে আবার নতুন পোনা ছাড়ার কথা, সে সময় তারা তা করতে পারছেন না। চাষের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ দুর্লভ হওয়ার কারণেও মৎস্যচাষিদের জীবিকা সংকটে পড়েছেন। লকডাউনে মাছের দাম কমে যাওয়া, বাজার বন্ধ হওয়াসহ বেশ কিছু সংবাদও নানা গণমাধ্যমে এসেছে। লকডাউনের কারণে হোটেল রেস্তোরাঁ ও নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় মাছের চাহিদার ওপর প্রচুর প্রভাব পড়ছে। এতসব কিছুর ফলে মৎস্য উৎপাদন ও বিপণনের যে শৃঙ্খল, সেটি বিঘিœত হচ্ছে।
এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের প্রান্তিক মৎস্যচাষি, পোনা উৎপাদনকারী, মৎস্য ব্যবসায়ী, মৎস্য পরিবহন, মৎস্য উৎপাদন ও পোনা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সবাই; শ্রমিকরা পর্যন্ত। এই শৃঙ্খল থমকে যাওয়ায় আগামীতে বাংলাদেশের মৎস্য চাষ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। পেটের দায়ে অনেকে মৎস্য আহরণের কাজ নিয়মিত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলমান রাখলেও কোনোভাবেই উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না। ফলে তাদের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা যেমন হুমকির মুখে তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও তারা দৈন্যদশায় পতিত হচ্ছেন। দেশের ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী, যারা বিশ্বজুড়ে ‘স্মল স্কেল ফিশারিজ’-এর বড়সড় অংশীদার, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে আরও অবনতির সমূহ আশঙ্কা করছেন মৎস্য খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত মাছ রপ্তানিতে স্থবিরতা নেমে আসায় বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে। রপ্তানি বন্ধ থাকায় চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাবের সংবাদ গণমাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে, প্রলয় সৃষ্টিকরা ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে আমাদের মাছ উৎপাদনের প্রধান বিভাগ খুলনার ছয় জেলার ১৯৭টি ইউনিয়নের বিরাট মৎস্য খাতে মোট ২৮৪ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়। কার্প জাতের মাছ (সাদা মাছ), চিংড়ি, কাঁকড়া, কুঁচিয়ার পাশাপাশি সেখানকার অবকাঠামোগত ক্ষতিও ব্যাপক।
সার্বিকভাবে মহামারী ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে আমাদের মৎস্য খাতে জড়িত সব শিল্প অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও হচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ ও ভবিষ্যতে করণীয় খুব দ্রুত ভাবা প্রয়োজন। মৎস্য খাতের প্রবৃদ্ধির হার সচল রাখতে ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন সংস্থা, দাতা সংস্থা ও গবেষকদের একত্রে কাজ করতে হবে। উল্লেখ্য, দেশের উপকূলের জেলেদের করোনাভাইরাস ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে নৌবাহিনী কাজ করছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রথম থেকেই একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ মৎস্য চাষ, ব্যবস্থাপনা, মাছের খাদ্যপ্রয়োগ, মাছের চিকিৎসা ও মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে সৃষ্ট সমস্যায় সেবা দিতে বিনা পয়সায় ‘টেলিফোন সহায়তা সেবা’ চালু করেছে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খামারি, মৎস্য উৎপাদক, মৎস্য উদ্যোক্তাদের অর্থ সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা করেছে। এসব সহযোগিতা যাতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষি ও মৎস্যশ্রমিকরা দ্রুত পান সেই বিষয়টি খুবই জরুরি।
একই সঙ্গে জরুরি করোনা মহামারীর প্রভাব থেকে মৎস্য খাতকে রক্ষায় মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে গবেষণাগারের বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রকৃত ক্ষতি নিরূপণে গবেষকদের কাজ করা। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মহামারী পরবর্তী সময়ের করণীয় ঠিক করতে গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। দাতা সংস্থাগুলোর ঠিক করা উচিত, মৎস্য খাতের আসন্ন বিপদে কীভাবে কোথায় সহযোগিতা করবেন। মহামারী পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে খাদ্য নিরাপত্তা। বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বড় অবদান রাখা মৎস্য খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য তাই সরকারি-বেসরকারি কর্র্তৃপক্ষ ও উদ্যোক্তাদের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ও গবেষক, জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
iftekharfagun@gmail.com
Newspaper Link: https://www.deshrupantor.com/editorial-news/2020/06/21/226369